ভারতের মুসলিমবিদ্বেষী নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে গত বেশ কিছুদিন ধরে দেশটির বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এসব বিক্ষোভে সহিংসতার জন্য পরোক্ষভাবে শুধু মুসলমানদের দায়ী করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঝাড়খন্ডে এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘এসব আগুন কারা লাগাচ্ছে, সেটা তাদের পোশাক দেখলেই চেনা যায়।’ এবার এ ইস্যুতে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘বদলা’ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। বদলা হিসেবে মুসলিমদের সম্পদ জব্দ করে তা অন্যত্র বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ওই বিক্রিলব্ধ অর্থ থেকে বিক্ষোভকালীন সহিংসতা, ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে।
কদিন আগেই বেঙ্গালুরুতে আন্দোলনকারীদের ফাঁসাতে গাড়িতে পুলিশের আগুন দেওয়ার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে টুপি পরে ট্রেনে পাথর ছোড়ার সময় বিজেপি কর্মীসহ ছয়জনকে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয়রা। এমন পরিস্থিতিতেই মুসলিমদের সম্পদ জব্দের ঘোষণা দিয়েছে উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকার। এমন উদ্যোগের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
এইচআরডব্লিউ-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উত্তর প্রদেশ সরকার এই ‘বদলা’ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর মুজাফফরনগর জেলায় কোনও আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে অন্তত ৭০টি দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব দোকানপাটের প্রায় সবগুলোরই মালিক মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন।
মুজাফফরনগর উত্তর প্রদেশের একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন ও প্রস্তাবিত নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে গত কয়েকদিনে সেখানে তীব্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হয়েছে। বিজনৌর, সম্ভল, লখনৌ, মুজাফফরনগরসহ এই রাজ্যের বহু এলাকা গত কয়েকদিন ধরে এই প্রতিবাদ-আন্দোলনকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠে। বিক্ষোভকেন্দ্রিক সহিংসতায় বাস-ট্রেনসহ নানা সরকারি সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে এ রাজ্যে। সেখানে অন্তত ১৮ বিক্ষোভকারীর নিহত হয়েছেন। বিক্ষোভে গুলি চালানোর কথা স্বীকার করেছে রাজ্য পুলিশ।
এরই মধ্যে উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকার জানিয়েছে, তারা সিসিটিভি ফুটেজ থেকে বিক্ষোভকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দোকানপাট ও সম্পত্তি জব্দ করবেন, যাতে সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের ক্ষতি সেখান থেকে পুষিয়ে নেওয়া যায়।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, সরকারি সম্পদ যারা ভাঙচুর করেছে বা আগুন ধরিয়েছে, হামলাকারীদের সম্পত্তি নিলাম করেই সেই অর্থ উসুল করা হবে। এই হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিশোধ নেবো।’
যোগী আদিত্যনাথের এই বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বিবিসি-কে বলেছেন, ‘প্রথমত সরকার কোনও সুনির্দিষ্ট কারণ না দেখিয়ে সাধারণ মানুষের দোকানপাট সিল করে দিতে পারে না। সরকার তাদের মর্জিমাফিক এ ধরনের কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে না। একমাত্র আদালত বললে তখনই হয়তো এ ধরনের শাস্তি দেওয়া যায়। আর দ্বিতীয়ত, একজন মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে বদলা নেওয়ার কথা বলতে পারেন?’
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। তিনি আইনের কথা বলবেন, তার মুখে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা কোনওভাবেই শোভনীয় নয়।’
মানবাধিকার কর্মীরা যতই প্রতিবাদ করুন, উত্তর প্রদেশ সরকার কিন্তু তাদের যেমন কথা তেমন কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে।
মুজাফফরনগরের নাসিম আহমেদের পুত্র ইনাম ইলাহীর দোকান ‘ওপি এন্টারপ্রাইজ’ ক্রোক করে পুলিশ সেখানে নোটিশ টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের অপরাধে ইনাম ইলাহীর সাত লাখ রুপিরও বেশি জরিমানা করা হয়েছে। এ অর্থ আদায় করা হবে তার দোকান ও সম্পদ নিলামে তুলে।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক যোগী আদিত্যনাথ বরাবরই তার মুসলিমবিরোধ মন্তব্যের জন্য পরিচিত। তার একটি আলোচিত উক্তি ছিল এমন, ‘যদি অনুমতি পাই তাহলে দেশের প্রত্যেকটি মসজিদে গৌরী-গণেশের মূর্তি স্থাপন করে দেবো।
সূত্র: বিবিসি